What I have seen of Dhoni, I still think he has a huge amount to offer to Indian cricket
— Nasser Hussain, Former England captain
জীবনে এমন কিছু কিছু মুহুর্ত থাকে যেখানে আমাদের ইচ্ছে করে সময়কে থামিয়ে দিতে। যেন মনে হয় সেই মূহুর্তগুলি কখনও যেন শেষ না হয়। অনন্তকাল ধরে যেন অনুভব করতে পারি আমরা সেই মূহুর্তগুলো, যেন ধরে রাখতে পারি মনের মণিকোঠায়! যেমন...রজার ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ড বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর শূণ্যে ভেসে ব্যাকভলি; শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেট ড্রাইভ বা বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভ আর অবশ্যই ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে এমএস ধোনির সেই হেলিকপ্টার শট।
আচ্ছা এই সময়টাতো তাঁকে চেন্নাইয়ে দেখতে পাবার কথা। ৭ নং হলুদ জার্সি গায়ে উইকেটের পেছন থেকে সেই অভ্যস্ত ঢংয়ে ফিল্ডিং সাজাচ্ছেন, বোলার কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন আর ব্যাট হাতে চাপের ম্যাচ একক দক্ষতায় জিতে ফিরে আসছেন। কিন্তু আশ্চর্য! কে উনি? বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে যাকে দেখা যাচ্ছে? একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি, একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল! যিনি রাঁচির বাড়িতে স্ত্রী-কন্যা ও পোষ্যর সাথে সময় কাটাচ্ছেন?
উত্তরটা আর আমায় বলে দিতে হবেনা। সবাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি মহেন্দ্র সিং ধোনির কথা বলছি আর চেন্নাইবাসীর প্রিয় 'থালা' কেন এখন চিপক ছেড়ে রাঁচিতে বসে সেই কারণও সকলেই জানেন। কারণটা হলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রকোপ আর তার জেরে প্রায় সমগ্র বিশ্বজুড়ে চলা লকডাউন যার ফলে জনজীবন প্রায় স্তব্ধ বিগত কয়েকমাস ধরে এবং স্বভাবতই যার আঁচ এসে পড়েছে খেলার দুনিয়াতেও। সারা বিশ্বে বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্ট, টুর্নামেন্ট ইত্যাদি থমকে গেছে এই মারণ ভাইরাসের আতঙ্কে এবং আইপিএল ও যার অংশ। সন্ধ্যা আটটায় টিভির সামনে ভারতীয় ক্রিকেটের মেগা ইভেন্টর বদলে এখন চলছে 'করোনা ব্রেকিং'!
কিন্তু করোনা ভাইরাস, লকডাউন, আইপিএল থমকে যাওয়া এই সবকিছুর সাথে এম এস ধোনির কি সম্পর্ক? উত্তরটা খুব একটা কঠিন নয় কারণ স্বয়ং ধোনি থেকে শুরু করে তাঁর লক্ষ-কোটি ভক্তকুল খুব ভালো করেই জানেন সম্পর্কটা ঠিক কি। এই করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে আন্তর্জাতিক স্পোর্টস ক্যালেন্ডার ওলটপালট হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ধোনির ভবিষ্যতের উপরেও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন চিহ্ন।
This guy has served to the best of his ability. He should leave cricket with dignity. I don't know why he dragged it for so long. He should have retired after the World Cup — Shoaib Akhtar, Former Pakistan Fast Bowler
এম এস কে সর্বশেষ দেখা গেছে গত জুলাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচে। এটাই ছিল তাঁর এখনও অবধি সর্বশেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ। তারপর থেকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাঁকে আর ভারতীয় দলে দেখা যায়নি। এই প্রশ্নের উত্তর সকলে খুঁজে বেড়িয়েছেন কিন্তু রহস্য রহস্যই থেকে গেছে। কেন ম্যাচ ফিট থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকাপের পর থেকে আর তাঁকে দেখা গেল না তা এখনও অজানাই রয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পরাজয়ের পর থেকে তিনি কেন অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন সেই সম্পর্কে বা তাঁর অবসর গ্রহণের পরিকল্পনার বিষয়েও জনসমক্ষে কোনও কথা বলেননি তিনি। তাই পুরো ব্যাপারটাই রয়ে গেছে কিছু 'যদি', 'কিন্তু' -র আড়ালে আর প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের অবসরকে ঘিরে শুরু হয়েছে হাজারো জল্পনা।
২০১৪ সালে ধোনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন তাই কিছুদিন আগে শেষ হওয়া রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর অংশগ্রহণ না করাই অবাক হওয়ার মতো কিছু হয়নি। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয়টি হল ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফি এবং পঞ্চাশ ওভারের বিজয় হাজারে ট্রফি - তে তাঁর অনুপস্থিতি। এই দু'টি টুর্নামেন্টের শেষে, গত বছর ডিসেম্বরেই এটি মোটামুটিভাবে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ধোনির ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারার একমাত্র উপায় হচ্ছে ১৩ তম আইপিএলের মঞ্চে নিজেকে আবারও প্রমাণ করা।
যদিও আইপিএল কখনোই কোনও খেলোয়াড়ের ফর্ম বিচার করার জন্য সেরা প্ল্যাটফর্ম হতে পারে না বিশেষ করে খেলোয়াড়টির নাম যখন হয় ধোনি, কারণ গতবছর আইপিএলেও ধোনি দুর্দান্ত ছন্দে ছিলেন তবে ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপের আসরে যদিও সেরা ফর্মে ছিলেন না। এসবকিছুর মধ্যেই জোরালো হয়েছে ধোনির ভবিষ্যত নিয়ে জল্পনা যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে শুরু করে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্যে উস্কে উঠৈছে বারবার। ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রী অবধি গত জানুয়ারি মাসে বলেছিলেন যে, "টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য দল বেছে নেওয়ার সময় আইপিএল 2020-এ ধোনির ফর্ম অবশ্যই বিবেচনা করা হবে।" শাস্ত্রী আরও বলেছিলেন যে তাঁর মনে হয়, "এই বয়সে এসে ধোনি সম্ভবত ক্রিকেটের একটা ফরম্যাট — টি-টোয়েন্টিই খেলতে চাইছে। ধোনি অবশ্যই আইপিএল খেলবে এবং ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁর ফিটনেসের দিকে নজর রাখবে। আইপিএল চলাকালীন তিনি কিরকম খেলছেন ও উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাতে অন্যান্য প্লেয়ারদের সাথে তাঁর ফর্মেরও তুলনা করেও দেখা হবে। এবছর আইপিএল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এটিই শেষ টুর্নামেন্ট হতে পারে যার থেকে বিশ্বকাপের জন্য আপনার ১৫ জন প্লেয়ারকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
কিন্তু কোভিড-১৯ -এর কারণে আইপিএল ২০২০ এখন বিশবাঁও জলে। আর এখানেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধোনির ভবিষ্যত নিয়ে বড়ো একটি প্রশ্ন চিহ্ন ফুটে উঠেছে। করোনা ভাইরাস রোগটি প্রত্যেকদিনের সাথে সাথে যেভাবে দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়ছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে করে খাতায় কলমে আশা থাকলেও একথা একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এবছরের মতো আইপিএল মোটামুটি বাতিল হয়ে যেতে পারে কারণ এইসমস্ত স্থগিতাদেশ মানে সারাবছরের স্পোর্টস ক্যালেন্ডারটিকেই আবার নতুন করে সাজাতে হবে এবং সেটা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন এই মারণ রোগের প্রাদুর্ভাব কমবে যার কোনও আশা এই মূহুর্তে নেই। আর এই সবকিছুকে ঘিরেই ধোনির ভারতীয় দলে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
I am not going to be diplomatic. If the IPL doesn't happen then his chances are very, very bleak — Krishnamachari Srikkanth, Former India batsman and ex-chief selector
করোনা ভাইরাসের জন্য বিশ্বব্যাপী এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে আমাদের দীর্ঘদিন লকডাউনের মধ্যে থাকতে হতে পারে। আর যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন সেখানে ক্রিকেট বা কোনও স্পোর্টসই বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে প্রচুর পরিমাণে পরিবর্তন আসতে পারে। তাই আইসিসি বললেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কি তার নির্ধারিত সময়ে শুরু হতে পারবে নাকি টুর্নামেন্টটিকে পরের বছরে ঠেলে দেওয়া হবে? আর আইপিএলও কি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অনুষ্ঠিত করা যাবে নাকি তার পরে কখনও খেলা হবে? অবশ্য যদি আইপিএল হয়! সবটাকে ঘিরেই এখন নানান প্রশ্ন যার কোনও উত্তর কারও কাছে নেই।
আইপিএল ২০২০ যদি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে হয়, তাহলে হয়তো ধোনির কাছে একটা সুযোগ থাকবে। কয়েক মাসের দেরি নিয়ে খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যদি পরের বছর অবধি পুনরায় পিছিয়ে যায় তাহলেই ঘনিয়ে উঠতে পারে কালো মেঘ। হয়তোবা এমনটাও হতে পারে ধোনির আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে ইতি নেমে আসবে এখানেই। বিশ্বকাপের পর থেকে পুরো ২০১৯ জুড়ে নিজেকে আন্তর্জাতিক তথা কোনওরকম ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে সরিয়ে রেখেছেন দু'বারের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। ভারতীয় দলে পুনরায় ফেরার মঞ্চ হিসাবে হয়তো তিনি আইপিএল -এর উপরেই নির্ভর করছিলেন। কিন্তু আইপিএল বা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পিছিয়ে গেলে তাকে আবারও দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ফিরে আসতে হবে যদি তিনি টিম ইন্ডিয়ায় প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখেন তো। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে যা এককথাই অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।আর যেহেতু তাঁর বয়সও বাড়ছে এবং নির্বাচকমন্ডলী তথা ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট বরাবরই বলে আসছে যে তারা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নতুন মুখ খুঁজছেন, তাতে করে ক্যাপ্টেন কুলের পক্ষে কামব্যাকের রাস্তাটা রীতিমতো কঠিন হতে চলেছে।
গতবছর বিশ্বকাপের পরেই অনেকে ভেবেছিলেন যে এই বুঝি শেষ। আর নয়। এবারই হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন মাহি। কিন্তু বিশ্বকাপের পর অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধোনির কেরিয়ার নিয়ে হাজারো জল্পনা। গত জানুয়ারিতে বিসিসিআইয়ের সেন্ট্রাল কনট্র্যাক্টের লিস্ট থেকেও যখন বাদ পড়লেন তখনই সকলেই মোটামুটি ভবিষ্যতটা পড়তে পারছিলেন আর তাই সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ট্রেন্ডিং হয়েছিল #ThankYouDhoni. কিন্তু কে জানতো দু'দুটো বিশ্বকাপ ও একটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ী দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়কের ভবিষ্যত ঘিরে এরকম অনিশ্চিয়তা তৈরি হবে! কেই বা জানতো কেরিয়ারের শেষলগ্নে এসে একের পর এক অপমান আর সমালোচনার বাণে বিদ্ধ হতে হবে! প্রিয় অধিনায়কের সতীর্থরা, প্রাক্তন ক্রিকেটার ও বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন যে, ধোনি নিজেই ঠিক করবেন তাঁর কেরিয়ারে তিনি কখন ইতি টানবেন। এই পুরো ব্যাপারটা ধোনির উপরেই ছেড়ে দিতে চান তাঁরা।
কিন্তু তিনি মহেন্দ্র সিং ধোনি। ক্যাপ্টেন কুল। চিরটাকাল যেমন ধ্যানমগ্ন এক সন্ন্যাসীর মতো ভাবলেশহীন থেকেছেন আজও সেই একইরকম। এত অপমান, সমালোচনা, তাঁর কেরিয়ার নিয়ে কাটাছেঁড়া — সবকিছুর মধ্যে যেন থেকেও নেই তিনি। কিন্তু তাঁর অগণিত ভক্তকুল আশায় বুক বেঁধেছিল আসন্ন আইপিএলেই হয়তো এই সবকিছুর জবাব দেবেন তাদের প্রিয় মাহি। ব্যাট হাতে জ্বলে উঠবেন আবারও। কিন্তু করোনা ভাইরাস আর তার জেরে লকডাউন সবকিছু যেন হঠাৎ করেই ঘেঁটে দিয়েছে। কিন্তু মন যে মানতে চায় না। যতই ফর্ম পড়ে যাক তবু অগণিত ভক্তকুল বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি যে সেরা ফিনিশার। তাঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শেষটা নিশ্চয়ই এভাবে হতে পারে না?
I would definitely like to see Dhoni in India's World Cup squad but it's highly unlikely that is going to happen. The team has moved on. Dhoni isn't someone to make big announcements so I reckon he would silently retire from the game — Sunil Gavaskar, Former India Captain
তাহলে কি ২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেই শেষবারের মতো ৭ নম্বর নীল জার্সিটা গায়ে দেখা গেল তাঁকে? তবে কি দুঃস্বপ্নের মতো বেজে উঠল বিদায়ী সুর? নাকি সীমিত ওভারের ক্রিকেটের 'কামব্যাক কিং' কামব্যাক করবেন আবারও রাজার মেজাজেই? সব সমালোচনা, সব অপমান, সব জল্পনাকে হেলিকপ্টার শটের মতোই উড়িয়ে দিয়ে সেই স্মিতহাসি মুখে একরাশ লজ্জা ফিরিয়ে দেবেন তাঁর সমালোচকদের দিকে? এ প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে!
"বিদায় যখন চাইবে তুমি দক্ষিণসমীরে
তোমায় ডাকব না তো ফিরে।
করব তোমায় কী সম্ভাষণ,
কোথায় তোমার পাতব আসন
পাতা-ঝরা কুসুম-ঝরা নিকুঞ্জকুটিরে॥
তুমি আপনি যখন আসো তখন আপনি কর ঠাঁই–
আপনি কুসুম ফোটাও, মোরা তাই দিয়ে সাজাই।
তুমি যখন যাও চলে যাও সব আয়োজন হয়-যে উধাও–
গান ঘুচে যায়, রঙ মুছে যায়, তাকাই অশ্রুনীরে।।"
~ শুভম দে
Comments
Post a Comment