"নয়নসমুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই
আজি তাই শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।"
সালটা ১৯৪৫। তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনের বছর সাতের ছেলেটিকে স্কুলের ক্রিকেট টিমে নিতে চাইতেন না টিমের ক্যাপ্টেন ও তার সহপাঠী, বুদ্ধদেব গুহ (প্রখ্যাত সাহিত্যিক, 'ঋজুদা' -র স্রষ্টা)। কারণ কি? না তার ধারণা ফুটবলের চেয়ে বেশি কঠিন খেলা খেলতে পারবে না ছেলেটি। একদিন দেশপ্রিয় পার্কে একটা ম্যাচে কিছু ছেলে খেলেনি। সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছিল ছেলেটি। কিন্তু যখন পরপর উইকেট পড়তে লাগলো তখন বাধ্য হয়ে সেই ছেলেটিকেই ব্যাট করতে ডাকলেন ক্যাপ্টেন। ব্যাট হাতে অপরাজিত ৪৫ রান এবং বল হাতে ৪ টি উইকেট নিয়ে ছেলেটি বুঝিয়ে দেয় ফুটবলের সাথে ক্রিকেটেও সে সমান পারদর্শী।
কোচবিহার ট্রফির জন্য বাংলা স্কুল টিমের ট্রায়াল চলছে। ট্রায়ালে উপস্থিত বিখ্যাত সাসেক্স অলরাউন্ডার বার্ট ওয়েনসলি এবং ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার পিয়ারসন সুরিতা। ৩০-৪০ জন ছেলের মাঝে ওয়েনসলি বছর চোদ্দোর একটি ছেলেকে লক্ষ্য করলেন এবং ডেকে বললেন "আমি তোমাকে টিচ বলে ডাকব"। কারণ কি? না ছেলেটির বোলিং দেখে কিংবদন্তি ইংলিশ লেগ স্পিনার টিচ ফ্রিম্যানের মতো লেগেছিল সাহেবের। তৃতীয় দিনে তিনি বললেন, "টিচ, তুমি খানিকটা ব্যাট করবে, খানিকটা বল করবে, খানিকটা ফিল্ডিং করবে।" এইভাবেই শুরু হয়েছিল ছেলেটির ক্রিকেট যাত্রা। কে জানত পরে এই ছেলেই বাংলা কে নেতৃত্ব দেবে রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে?
কি মনে হচ্ছে? কোনও ক্রিকেটারের কথা বলছি? তাহলে চলুন ফিরে যাওয়া যাক ১৯৪৬ সালে। ছেলেটির বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। ক্লাস টু -এ পড়ে। দেশপ্রিয় পার্কের মাঠে চুটিয়ে বল পেটায়। কীভাবে যেন কিংবদন্তি ফুটবলার ও কোচ বলাইদাস চ্যাটার্জির (১৯৪৮ অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল টিমের কোচ) চোখে পড়ে যায় ছেলেটি। এরপর ওনার হাত ধরেই মোহনবাগানে আসা। ১৯৪৬ সালে মোহনবাগানের জুনিয়র দলের ট্রায়ালে উত্তীর্ণ হয়ে সেই শুরু। কে জানত ভারতীয় ফুটবলের 'গোল্ডেন বয়' হয়ে উঠবে এই ছেলে?
বল পায়ে তার ম্যাজিক? নাকি বল হাতে চমৎকার রান আপ? শুধুমাত্র কিছু শব্দ দিয়ে কি আর তাকে বর্ণনা করা যায়? শব্দের ভান্ডার যে ফুরিয়ে আসে তার বর্ণময় কেরিয়ারের কথা লিখতে গেলে। তিনি যে মহীরুহ!
ভারতীয় ক্রীড়া জগতের মহাকাশে তাঁর মতো উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়তো আর একটা নেই। ক্রিকেট থেকে ফুটবল, হকি থেকে টেনিস সব খেলাতেই সমান দক্ষ।প্রকৃতপক্ষেই তিনি একজন সত্যিকারের 'অলরাউন্ডার'। অবিশ্বাস্য প্রতিভার অধিকারী সেই মানুষটির নাম সুবিমল গোস্বামী। অবশ্য তাঁর ডাকনামেই (চুনী) সারা বিশ্ব চেনে তাঁকে। জন্ম ১৯৩৮-এর ১৫ জানুয়ারি, অধুনা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। বাবা রেলে চাকরি করতেন। বাবার কর্মসূত্রেই কলকাতায় আসা। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে লেখাপড়া করে নামী কোম্পানিতে চাকরি করুক। খেলায় কখনও উৎসাহ দেননি। কিন্তু মা ছিলেন ঠিক উল্টো। মা ফুটবলের জার্সি, প্যান্ট, জুতো এগিয়ে দিতেন। খেলতে পাঠাতেন ছেলেকে। ফুটবলার হওয়ার পিছনে তাঁর মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। আট বছর বয়সে মোহনবাগান জুনিয়র টিমে ফুটবলে হাতেখড়ি। গুরু বলাইদাস চ্যাটার্জি কি জানতেন আক্ষরিক অর্থে ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যতের 'চুনী' -টিকেই আবিষ্কার করেছেন তিনি?
মোহনবাগান:
১৯৪৬ -এ সেই যে মোহনবাগান জুনিয়র দলে ঢুকলেন সেটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তাঁর ফুটবল জীবনে আর অন্য কোনও ক্লাবে খেলেননি তিনি। তারপর ২৯ মে, ১৯৫৪ তে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিনিয়র দলে অভিষেক। মোহনবাগানের দুই অলিম্পিয়ান রুনু গুহঠাকুরতা এবং আব্দুস সাত্তার চাকরিগত কারণে শেষ মুহূর্তে ম্যাচটা খেলতে পারেননি। অবিশ্বাস্যভাবে ডেবিউ করেছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে থাকা চুনী গোস্বামী। অবশ্য ইস্টার্ন রেলের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে খেলার কথা ছিল রবীন পাত্রের। কিন্তু কোচ বলাইদাস চ্যাটার্জির আশীর্বাদের হাত চুনী গোস্বামীর মাথায় বরাবর ছিল বলেই সেই দিন কোচ জার্সি তুলে দিয়েছিলেন চুনী গোস্বামীর হাতে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। রবিন পাত্র সেই সময় ছিলেন অপরিহার্য রাইট ইন ফরোয়ার্ড। চুনী জুনিয়রে রাইট ইন খেলেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় চুনীকে লেফট ইন ফরোয়ার্ডের জায়গায় খেলানোর। যদিও পরিকল্পনামাফিক নয়, সেই ঘটনার ফলেই চুনী লেফট ইন পজিশনে খেলা শুরু করেন। খেলা ছাড়া অবধি, দেশের সেরা এবং এশিয়ার অন্যতম সেরা লেফট ইন ফরোয়ার্ড ছিলেন চুনী গোস্বামী।টি আও, মহাবীর প্রসাদ, করুণা ভট্টাচার্য, অনিল দে, উমাপতি কুমার, শৈলেন মান্নার মতো ফুটবলারদের মাঝে গুটি সুটি মেরে বসে থাকতেন তিনি। প্রচণ্ড রোগা ছিলেন। অনেকের আশঙ্কা ছিল, রোগা শরীর নিয়ে এই ছেলেটা ফুটবলের মতো বডি কন্ট্যাক্ট গেমে পাল্লা দিতে পারবে কিনা। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। প্রতিভা চাপা থাকেনি। দুরন্ত বল কন্ট্রোল ও ড্রিবলিংয়ে সকলের মন জিতে নিয়েছিলেন।আর এরপরই সবুজ-মেরুনে শুরু হয় চুনী পর্ব। প্রায় ২২ বছর মোহনবাগানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৬০ থেকে অবসর নেওয়া অবধি তিনি ছিলেন ক্লাবের অধিনায়ক। মোহনবাগানের হয়ে গোল করেছেন ২০০ টি (কলকাতা ফুটবল লিগে ১৪৫ টি, আইএফএ শিল্ডে ২৫ টি, ডুরান্ড কাপে ১৮ টি রোভার্সে ১১ টি এবং এইচ কে মুখোপাধ্যায় শিল্ডে ১টি গোল) এবং ২৯ টি ট্রফি (মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৪টি) জিতেছেন (কলকাতা ফুটবল লিগ জিতেছেন ১০ বার, আইএফএ শিল্ড ৫ বার, ডুরান্ড কাপ ৫ বার, রোভার্স ৩ বার, এইচকে মুখোপাধ্যায় শিল্ড ৫ বার এবং বাবু কুয়ের সিং শিল্ড ১ বার ও অমৃতবাজার পত্রিকা শতবার্ষিকী ট্রফি ১ বার)। টানা চারবার কলকাতা লিগ জিতেছেন (১৯৬২- ৬৫), টানা তিনবার আইএফএ শিল্ড জিতেছেন (১৯৬০- ১৯৬২) এবং টানা তিনবার ডুরান্ড কাপ জিতেছেন (১৯৬৩-১৯৬৫)।
ঘরোয়া টুর্নামেন্টে চুনী গোস্বামীর সেরা সাফল্য ছিল ডুরান্ড কাপে। যেখানে মোহনবাগান ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৫ - প্রত্যেক বছর ফাইনাল খেলেছে। ১৯৬৩র ডুরান্ড ফাইনাল রিপ্লে হয়েছিল। অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে চুনী দুই হাফেই গোল করে দলকে ২-০ জেতায়। সেই প্রথমবার তাঁর হায়দরাবাদের পুলিশ টিমকে হারায়। তার আগে দু’বার ১৯৫০ এবং ১৯৬১-তে মোহনবাগান অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের কাছে ফাইনালে হেরেছিল। ১৯৬৪-তে টাটা স্পোর্টস ক্লাব এবং ১৯৬৫-তে অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে চুনী গোস্বামীর করা গোলেই মোহনবাগান ফাইনালে উঠেছিল।
ডুরান্ড কাপ ভারতের প্রাচীনতম এবং ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট। ডুরান্ড ফাইনালে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকতেন এবং দুই দলের অধিনায়কের সঙ্গে চা পান ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। তখন ১৯৬৫ তে, রাষ্ট্রপতি ডা. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন দিল্লি গেট স্টেডিয়ামে (বর্তমানে, আম্বেদকর স্টেডিয়াম) গিয়েছিলেন মোহনবাগান আর পঞ্জাব পুলিশের মধ্যে ডুরান্ড কাপ ফাইনাল দেখতে। মোহনবাগান বেঞ্চের সামনে চুনীকে ওয়ার্ম আপ করতে দেখে, রাষ্ট্রপতি চুনীকে গিয়ে বলেন - "ওহ্ আবার চুনী! তুমি তো ফাইনাল খেলাটা একেবারে পাকা করে ফেলেছ দেখছি।" এমনই ছিল চুনী গোস্বামীর খ্যাতি এবং মর্যাদা।
মোহনবাগান শুধুমাত্র একটি ক্লাব ছিল না তাঁর কাছে। মোহনবাগান ছিল তাঁর কাছে মাতৃসম। শোনা যায় একবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লাল-হলুদের জেনারেল সেক্রেটারি জে সি গুহ (জ্যোতিষ চন্দ্র গুহ) তাঁকে ইস্টবেঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ষাটের দশকে বাজারে নতুন আসা জনপ্রিয় ফিয়াট গাড়ি উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও ‘সবুজ-মেরুন' -এর তাঁবু থেকে ভাঙানো যায়নি তাঁকে। অত্যন্ত নম্রতার সাথে উনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রিয় মোহনবাগানেই থেকে যান। এমনই ছিল তাঁর মোহনবাগান প্রেম যে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইউরোপের বিখ্যাত ক্লাবে ট্রায়ালের প্রস্তাবও! তখন দেশের হয়ে ও ক্লাবের হয়ে চুটিয়ে খেলছেন চুনী গোস্বামী। সেই সময় সুদূর সাগরপাড় থেকে প্রস্তাব আসে তাদের ক্লাবের ট্রায়ালে যোগ দেওয়ার জন্য। তাদের ম্যানেজার ছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার বিল নিকোলসন। কিন্তু তিনি যাননি। মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন ছিলেন তখন। মোহনবাগানের বিখ্যাত কর্তা ধীরেন দে তাঁকে বলেছিলেন, "ওখানে একা একা থেকে কী করবে?" তাই আর ইংল্যান্ডে গিয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। ক্লাবটির নাম ছিল টটেনহাম হটস্পার! ক্লাবের প্রতি ভালবাসা এতটাই গভীর ছিল যে আলাদা করে কখনও বেতন নেননি। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "মোহনবাগানে প্র্যাকটিসের পর কলা আর পাউরুটি দেয়। ওটাই যথেষ্ট।" এখানেই চুনী গোস্বামী ছিলেন শ্রেষ্ঠ। বাকি সবার থেকে আলাদা। মোহনবাগান ক্লাবের প্রতি তাঁর আনুগত্য, দায়বদ্ধতা তাঁর নাম মোহনবাগান ক্লাবের সাথে সমার্থক করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন মোহনবাগানের ঘরের ছেলে।
সন্তোষ ট্রফি:
বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেছেন ১৯৫৬-১৯৬০। গোল করেছেন ২৫ টি। চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনবার। ১৯৫৬ তে প্রথম সন্তোষ খেলেন চুনী গোস্বামী। এরনাকুলামে মহীশূরের বিরুদ্ধে বাংলার হয়ে জয়সূচক গোল করেন পি কে। সেই গোলটি এসেছিল চুনী গোস্বামীর থ্রু পাস থেকেই।
ভারতীয় ফুটবল দল:
১৯৫১ থেকে ১৯৬২ - এই সময়টাকে ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। আর এই স্বর্ণযুগের দ্যুতি আরও উজ্জ্বলতর করে তুলেছিলেন চুনী গোস্বামী নিজ মহিমায়। পি কে, চুনী, বলরাম (তুলসীদাস বলরাম) - এই ত্রয়ী কে তখন ভারতীয় ফুটবলের 'ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর' বলা হত। আন্তর্জাতিক ১৯৫৬ সালে এক স্মরণীয় ম্যাচে ভারতীয় ফুটবল পেয়েছিল তার 'চুনী' কে। সেই ম্যাচে ভারতীয় দল ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল অলিম্পিকে খেলা চিনা দলকে। আর এই ম্যাচেই ভারতীয় জার্সি গায়ে আবির্ভাব ঘটে বছর উনিশের এক যুবকের - যার নাম সুবিমল 'চুনী' গোস্বামী। ১৯৫৬ -র মেলবোর্ন অলিম্পিকে উপেক্ষিত হলেও ১৯৫৮ -র টোকিও এশিয়ান গেমসে ধুরন্ধর কোচ বাঘা সোম ২০ বছরের যুবকটিকে দলে নেন। এরপর আর কেউ তাঁর দক্ষতা অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস দেখায়নি। ২৬ শে মে ১৯৫৮, টোকিও এশিয়ান গেমসে বার্মার বিরুদ্ধে প্রথম গোল করেছিলেন। ভারত জিতেছিলেন ৩-২ গোলে। ভারতের হয়ে ৩৬ টি ম্যাচ খেলেছিলেন। ক্যাপ্টেন ছিলেন ১৬ টি ম্যাচে। গোল করেছেন ১৩টি। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে চুনী গোস্বামীর সেরা সাফল্য জাকার্তায় চতুর্থ এশিয়ান গেমসের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ হারিয়ে স্বর্ণপদক জয়। সেমিফাইনালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে ৩-২ জয়ের কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। দক্ষিণ ভিয়েতনাম দলের ৮ জন খেলোয়াড় সেই সময় ফ্রেঞ্চ লিগে খেলত। সেই ম্যাচে চুনী গোস্বামী জোড়া গোল করেন। তাঁর নেতৃত্বেই ভারত ১৯৬৪-তে ইসরাইলের তেল আভিভ এশিয়া কাপে রানার্স হয়। ১৯৬৪-র মারডেকা কাপেও চুনী অধিনায়কত্ব করেন।
একনজরে ভারতীয় দলে চুনী গোস্বামী:
প্রীতি ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট:
এশিয়ান গেমস - ১৯৫৮ ও ১৯৬২ জাকার্তা (ক্যাপ্টেন)
এশিয়া কাপ যোগ্যতা অর্জন ম্যাচ - ১৯৫৯ (এর্নাকুলাম)।
এশিয়া কাপ - ১৯৬৪ (তেল আভিভ)
প্রাক অলিম্পিক পর্ব - ১৯৫৯ (কাবুল), ১৯৬০ (কলকাতা), ১৯৬৩ (কলম্বো), ১৯৬৪ (তেহরান/ কলকাতা)
প্রীতি ম্যাচ - ফার্মোসার বিরুদ্ধে ১৯৬৪।
অলিম্পিক - ১৯৬০, মারডেকা কাপ ১৯৬১ ও ১৯৬৪ (ক্যাপ্টেন), প্রীতি ম্যাচ-১৯৬৪।
শচীন টেন্ডুলকার কে যদি ভারতীয় ক্রিকেটর ঈশ্বর বলা হয়, তাহলে চুনী গোস্বামী ছিলেন 'গড্ অফ ইন্ডিয়ান ফুটবল'। ড্রিবলিং -এ উনি ছিলেন ভারতের রোনাল্ডিনহো-রবিনহো। ভারতীয় ফুটবলের জাদুকর, যিনি ফুটবলে পা দিলেই ঘটত ম্যাজিক। উজ্জ্বলতা এবং লাবণ্যের বিচ্ছুরণ ফুটে উঠত মাঠজুড়ে। এহেন খেলোয়াড় যে যেকোনো টিমের কাছে সম্পদ যা ভালো করে জানতেন তদানীন্তন ভারতীয় ফুটবল টিমের বিখ্যাত কোচ সৈয়দ আবদুল রহিম। এমনকী দেরিতে জাতীয় দলে যোগ দিলেও কেউ অভিযোগ করত না তাঁর বিরুদ্ধে। ১৯৬০ -এ রোম অলিম্পিকের আগে প্রায় ১৫ দিন দেরিতে গোশামহল স্টেডিয়ামে জাতীয় শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিছু খেলোয়াড় এই নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন কোচের কাছে । কিংবদন্তি রহিম তাঁদের বলেছিলেন, "উসকে মাফিক বল কন্ট্রোল কর লো, তুম ভি ফির লেট আনা।" হ্যাঁ এই হচ্ছে চুনী গোস্বামী। ভারতীয় ফুটবলের 'গ্ল্যামার বয়'!
রাজার মতো থাকতে পছন্দ করতেন সব সময়। নিজেকে সুসজ্জিত রাখতে পছন্দ করতেন। মাঠ হোক বা মাঠের বাইরে তাঁর সবটাই ছিল রাজকীয়। আন্তর্জাতিক ফুটবল কে থেকে বিদায়ও জানিয়েছিলেন রাজার মতোই। ১৯৬৪ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে নিজের সেরা ফর্মে থাকাকালীন। সদ্য এশিয়ান কাপে রানার্স আপ হয়েছেন। আর সৈই সময়েই অবসর ঘোষণা। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কারণটা, যে এখনকার অনেকের মতো এটা শুনতে চাননি কেন চুনী খেলা ছাড়ছে না? বরং উল্টোটাই শুনতে চেয়েছেন, কেন ছাড়ল? যখন তিনি অবসর ঘোষণা করলেন, মুম্বাইয়ে তাঁর খেলার দুই বিশেষ ভক্ত তাঁর সাথে দেখা করে তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এই দুজন ভদ্রলোক হলেন দিলীপ কুমার এবং প্রাণ - বলিউডের এই দুই আইকন! আর এখানেই চুনী গোস্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিলেও ১৯৬৮ অবধি মোহনবাগানের হয়ে খেলা চালিয়ে যান তিনি।
ক্রিকেটের ২২ গজে চুনী গোস্বামী:
আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ঘোষণার পর সকলেই ভেবেছিলেন এবার হয়তো কোচিংয়ে দেখা যাবে তাঁকে বা স্টেট ব্যাঙ্কের মোটা মাইনের চাকরিতে মনোনিবেশ করবেন তিনি। কিন্তু তিনি চুনী গোস্বামী। থেমে থাকার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। খেলার মাঠই তাঁর জীবন। সব গুঞ্জন থামিয়ে ফিরে গেলেন ফুটবলের সাথে সমানতালে যে খেলাটা খেলে এসেছেন এতদিন সেই - ক্রিকেটের বাইশ গজে। আর তারপরেই ঘটল এমনকিছু ঘটনা যা যেকোনো মহাকাব্যকেও হার মানায়। ক্রিকেটের বাইশ গজে ঘটল 'চুণী' গজে ঘটল 'চুণী' গজে ঘটল 'চুণী' নামক রত্নের বিচ্ছুরণ! ! ! ক্রিকেটের মাঠে নিজের সীমিত ক্ষমতার যে বহিঃপ্রকাশ তিনি ঘটিয়েছিলেন তাতে আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা একটা 'ডেনিস কম্পটন' পায়নি আমাদের দেশে! ডানহাতি ব্যাটসম্যান তথা ডানহাতি ফাস্ট মিডিয়াম বোলার হিসাবে প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে ৪৬ টি ম্যাচ খেলেছিলেন চুনী গোস্বামী এবং একটি সেঞ্চুরি ও সাতটি হাফ-সেঞ্চুরি সহ ১৫৯২ রান করেছিলেন। সর্বোচ্চ রান ছিল ১০৩।বল হাতে একবার এক ইনিংসে ৫ উইকেট-সহ ৪৭ টি উইকেট নিয়েছিলেন, সেরা বোলিং ছিল ৫/৪৭। ১৯৬২-৬৩ মরশুমে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক ঘটেছিল তাঁর এবং ১৯৭২-১৯৭৩ অবধি বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলেছেন।
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩।
বাংলার হয়ে রঞ্জি অভিষেক আর প্রথম ম্যাচেই হেলমেটহীন অবস্থায় সামলাতে হয়েছিল হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের রক্তঝরানো ফাস্ট বোলার রয় গিলক্রিস্ট কে। গিলক্রিস্টের খুনে মেজাজ এবং যথেচ্ছ বাউন্সার-বিমার ব্যবহারের জন্য যে ম্যাচ কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। বাংলা অধিনায়ক পঙ্কজ রায়কে বিমার ছুড়ে মারতে গিয়েছিলেন গিলক্রিস্ট। ছয় নম্বরে নেমে গিলক্রিস্টকে সামলে চুনী গোস্বামীর ৪১ রান বাংলাকে প্রথম ইনিংসের লিড নিতে সাহায্য করেছিল। ইডেন দেখেছিল এক দুঃসাহসী চুনী কে।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।
বোম্বের বিপক্ষে ১৯৬৮-৬৯ -এর ড্র হওয়া রঞ্জি ফাইনালেও চুনী গোস্বামী বাংলা দলের অংশ ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ৯৬ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৪ রান করেছিলেন। তবে প্রথম ইনিংসের ঘাটতির কারণে বাংলা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
১৯৭১-৭২ রঞ্জি ট্রফি
তাঁর নেতৃত্বে বাংলা রঞ্জি রানার্স হয়েছিল ১৯৭১-৭২ সালে, ফাইনালে গাভাসকার-অশোক মানকড়-ওয়াদেকার-সোলকার-রমাকান্ত দেশাই-শিভালকার সমৃদ্ধ বম্বের কাছে ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে হেরে গিয়েছিল বাংলা। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে মহারাষ্ট্র আর সেমিফাইনালে পাতৌদি-জয়সীমা-আবিদ আলি সমৃদ্ধ হায়দরাবাদকে হারিয়ে দেওয়ার পিছনে অনেকাংশেই সক্রিয় ছিল বাংলা অধিনায়কের প্রখর মস্তিষ্ক।
তবে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে সেরা মুহূর্তটা ছিল ১৯৬৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, যা প্রায় লোকগাথায় পরিণত হয়।
আগে যখন বিদেশি দল ভারতে আসত, ওরা প্রস্তুতি ম্যাচ খেলত রঞ্জি ট্রফি জয়ী দলের সঙ্গে বা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে। ১৯৬৬ -তে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এল ভারত সফরে, ওরা তখন বিশ্বের এক নম্বর দল। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সিদ্ধান্ত নিল মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল - দু’টো আঞ্চলিক টিমকে এক করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলার জন্য যৌথ একাদশ গড়া হবে। হনুমন্ত সিংহ ছিল ছিল ক্যাপ্টেন। সব মিলিয়ে ছ’জন ছিল পূর্বাঞ্চল থেকে। দলজিৎ সিং, রমেশ সাক্সেনা, অম্বর রায়, সুব্রত গুহ,দেবু মুখোপাধ্যায় ও চুনী গোস্বামী। আর গ্যারি সোবার্স, রোহন কানহাই, ক্লাইভ লয়েড, ডেরেক মারে, ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ -এর মতো ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা সব নাম ছিল সেই ক্যারিবিয়ান দলে। যদিও সোবার্স আর কনরাড হান্ট প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলেননি। ইংরেজি সংবাদপত্রে শিরোনাম বেরিয়েছিল 'উইকেস্ট অপোজিশন টু ফেস মাইটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ'! স্টেট ব্যাঙ্কে খেলার সুবাদে অধিনায়ক হনুমন্ত সিংহ চুনী গোস্বামীকে চিনতেন। ওনার হাতে যে ভাল ইনসুইং আছে, সেটা জানত হনুমন্ত। টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমে ব্যাট করেছিল। কিন্তু চুনীর মিডিয়াম পেস সুইং ও সিম বোলিংয়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বিশ্বসেরা ক্যারিবিয়ান মহারথীরা! চুনী গোস্বামীর প্রথম কয়েকটা বল খেলার পর রোহন কানহাইয়ের মতো ব্যাটসম্যান এগিয়ে এসে চুনীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিলেন, "ইউ হ্যাভ গট অ্যা ফাকিং সুইং ম্যান"। আম্পায়ারের কাছে নতুন করে গার্ড চেয়েছিলেন কানহাই। কানহাই মাত্র ৪ রান করে চুনীর বলে গালিতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যায়। ১৩৬ রানে শেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ! চুনী গোস্বামী ৪৭ রান দিয়ে ৫ উইকেট। অবাক লাগছে? তাহলে অবাক হওয়া আরও বাকি।
২৮৩-৯ স্কোরে ডিক্লেয়ার করছিলেন ক্যাপ্টেন হনুমন্ত। ১৪৭ রানে এগিয়ে গেল মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মিলিত দল। বল হাতে চুনী-ম্যাজিকের পর ব্যাট হাতে ২৫ রান করেছিলেন চুনী গোস্বামী। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে এসে ফের চুনীর সুইংয়ের সামনে ধরাশায়ী। এবার ৩ উইকেট ঝুলিতে। শেষের দিকে ওয়েস হল আর লেস্টার কিং মিলে চালিয়ে খেলে রান তুলতে থাকে। আর এবার দেখা গেল ফিল্ডার চুনী গোস্বামীর এক ঝলক। হল, সুব্রত গুহর বল স্ক্যোয়ার লেগের দিকে তুলে মারলে, মিড-অন থেকে দৌড় শুরু করেন চুনী গোস্বামী। খুব উঁচুতে উঠেছিল বলটা। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছে এক হাত বাড়িয়ে অবিশ্বাস্য ক্যাচটি নিয়েছিলেন চুনী। বিস্ময়!
১০৩ রানে প্রতিপক্ষ কে শেষ করে দিয়ে মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মিলিত দল ম্যাচ জিতেছিল এক ইনিংস ও ৪৪ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারের অপমানের বদলা নিতে পরের টেস্টে ইনিংসে হারায় ভারতকে। কিন্তু সে যাইহোক সারা জীবনের মতো ভারতীয় ক্রিকেটের লোকগাথায় ঢুকে গিয়েছিল চুনী গোস্বামীর এই অসাধারণ পারফরম্যান্স। মাঠের মধ্যে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি, বিড়বিড় করে বলতেন, "চুনী, তুমি বাঘের বাচ্চা, লড়ে যাও শালা, ছাড়বে না"।
এই ছিল চুনী গোস্বামী। একইসাথে দুটো খেলায় (ফুটবল ও ক্রিকেট) রাজ্যদলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমন খেলোয়াড় আসমুদ্র-হিমাচলে আর একটাও নেই। ঈশ্বরপ্রদত্ত না হলে কি এমন প্রতিভাধর কোনো মানুষ হতে পারে? তবে ক্রিকেট খেলতে ভালবাসলেও নিজেকে একজন ফুটবলার বলতেই গর্ববোধ করতেন তিনি।
টেনিসের কোর্টে চুনী:
ফুটবল-ক্রিকেট কে বিদায় জানানোর পর এবার টেনিস। খেলাধুলাই ছিল তাঁর জীবন। টেনিস ভালোবাসতেন তিনি। ফুটবল-ক্রিকেট থেকে অবসরের পর তাঁকে প্রায়শই দেখা যেত ক্যালকাটা সাউথ ক্লাবের টেনিস কোর্টে।
স্টেট ব্যাঙ্কের চৌরঙ্গী শাখায় ম্যানেজার ছিলেন তিনি। যেখানে ইস্টবেঙ্গলের সুকুমার সমাজপতি অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে কাজ করতেন। ১৯৭০ -এর শেষের দিকে গ্রীষ্মকালে যখন লোডশেডিং হয়ে যেত, ব্যাঙ্কে হাজার গ্রাহকের চাপ থাকুক, চুনী গোস্বামি চুপচাপ মধ্যাহ্নভোজনের পর চলে যেতেন সাউথ ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবে। মোমবাতির আলোয় গ্রাহকদের ভীড়ে কাজে ভীষন অসুবিধা হত সুকুমার সমাজপতির। কিন্তু চুনী গোস্বামী কখনও টেনিস মিস্ করতেন না। মোহনবাগানের হয়ে একটি ক্লাব টুর্নামেন্টও জিতেছিলেন জয়দীপ মূখার্জীর ও তিনি একসাথে খেলে।
লম্বা সুঠাম শরীরখানি আশি বছর বয়সেও সেই একইরকম ফিট ছিল। আগেই বলেছি বরাবর রাজার মতো থাকতে ভালোবাসতেন। নিজেকে নাম্বার ওয়ান মনে করতেন। মেজাজটাই ছিল আসল রাজা। ড্রেস সেন্স ও স্টাইল-স্টেটমেন্টে টেক্কা দিতে পারতেন এখনকার যেকোনো খেলোয়াড় কে। বর্তমান সময়ের স্টার হলে হাজারো বাণিজ্যিক সংস্থা তাঁকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করার জন্য উঠে পড়ে লাগত। অবশ্য চুনী গোস্বামী নিজেই একটা ব্র্যান্ড।
বর্তমান সময় যেভাবে মেসি-রোনাল্ডো কে পুজো করে, ওনার প্রজন্ম ওনাকে ঠিক সেইভাবেই পুজো করত এবং ভবিষ্যতেও করবে। ফুটবল পায়ে স্কিল, উজ্জ্বলতা এবং লাবণ্যে ভরা এক কিংবদন্তি। ওনার বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং, স্কিল, এবং বুদ্ধিদীপ্ত পাসিং ওনাকে সর্বভারতীয় স্তরে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিল। ফুটবল দক্ষতায় উনি ছিলেন রোনাল্ডিনহো বা রবিনহোর সমকক্ষ এবং সেই সময়ের যেকোনও ব্রাজিলীয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম ছিলেন। বর্তমান ভারতে মেসি বা রোনাল্ডোর ভক্ত সংখ্যার থেকেও বেশি ছিল তাঁর ভক্তের সংখ্যা। মোহনবাগানের হয়ে গোল করার পর কোমড়ে হাত দিয়ে মুচকি হেসে গ্যালারির দিকে তাঁর সেই তাকানো, খেলার পর যথারীতি 'গুরু, গুরু' বলে ভক্তদের চুনী গোস্বামীর পায়ে ডাইভ দেওয়ার দৃশ্য যারা তার খেলা দেখেছেন তাদের স্মৃতিতে আজও অমলিন। গগনচুম্বী ছিল তাঁর গ্ল্যামার। 'ময়দানের উত্তমকুমার' বলা হত ভারতীয় ফুটবলের 'গ্ল্যামার বয়' কে। এমনই জনপ্রিয়তা ছিল যে, দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তদের পাঠানো ঠিকানাবিহীন চিঠি তাঁর যোধপুর পার্কের বাড়ির লেটার বক্সে পৌঁছে যেত। খামের উপর শুধু লেখা থাকত - চুনী গোস্বামী, ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম, কলকাতা। সেইসময় নায়ক তো ছিলেন একজনই। আর তিনি চুনী গোস্বামী।
শোনা যায়, ১৯৬০ -এর দিকে একজন বৃদ্ধা রোজ ভোরবেলায় কালীঘাটে যেতেন। কিন্তু ফেরার সময় ভীড় বাড়লে তার অসুবিধা হত ট্রাম ধরতে। পাশের কাউকে তখন তিনি বলতেন, "আমি চুনী গোস্বামীর ঠাকুমা"। ব্যাস, শুধু বলার অপেক্ষা উপস্থিত সকল জনতা শুধু ট্রাম ধরিয়ে দেওয়ায় নয় পারলে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত একেবারে! এমনই ছিল চুনী গোস্বামীর জনপ্রিয়তা। ভক্তরা তাঁর জন্য সবকিছু করতে পারত। একবার ১৯৬৫ সালে কেরলের কুইলনে সন্তোষ ট্রফি খেলতে গিয়েছিল বাংলা দল। কিন্তু সেই দলে চুনী গোস্বামী ছিলেন না। স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীদের ক্ষোভ সামাল দিতে স্টেডিয়ামের বাইরে সংগঠকদের ওঁর মোমের মূর্তি বসাতে হয়েছিল। এই হচ্ছে চুনী গোস্বামী। ভারতীয় ফুটবলের মেগাস্টার।
চুনী গোস্বামী ছিলেন সেই নতুন ভোর যার হাত ধরে বিশ্বায়ন ঘটেছিল ভারতীয় ফুটবলের ভাগ্যাকাশে। স্টেডিয়াম ভর্তি জাকার্তায় যেদিন হাজার হাজার জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল সেদিন কি অনুভূত হয়নি সেই বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত?
"মহারাজ একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে
চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে
মহারাজ একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে
চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে
মহারাজ একি সাজে..."
এ কি বিশ্বকাপের থেকে কম কিছু? তবু বিশ্বকাপ না খেলতে পারার আক্ষেপ ছিল তাঁর। এই পোড়া দেশে না জন্মালে হয়তো বিশ্বকাপ খেলার তকমাটাও জুড়ে যেত তাঁর সাথে।
কোচিংয়ের সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির প্রথম ডিরেক্টর হয়েছিলেন (১৯৮৬-১৯৯০)। পুরস্কৃত হয়েছেন দেশের সেরা সম্মানে: পদ্মশ্রী (১৯৮৩), অর্জুন (১৯৬৩)। তাঁর ক্লাব তাঁকে 'মোহনবাগান রত্ন' সম্মানে ভূষিত করেছে ২০০৫ সালে। ঐ বছরেই কলকাতার শেরিফ ও হয়েছেন। সিএবি লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছে তাঁকে ২০১১-১২ সালে। বঙ্গবিভূষণ পেয়েছেন ২০১৩ সালে। ভারতীয় ডাক বিভাগ তাঁকে সম্মান জানিয়ে তাঁর ৮২ তম জন্মদিনে এই বছরেরই ১৫ ই জানুয়ারী পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করে। তৃতীয় ভারতীয় ফুটবলার হিসাবে ডাকটিকেট জায়গা করে নেন চুনী গোস্বামী।
এতসব রেকর্ড, এত জনপ্রিয়তা, এত খ্যাতি - সবকিছুর মায়া যেন ছিন্ন হল গত ৩০ শে এপ্রিল। নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাসে ভারতীয় ক্রীড়া জগতের মহাকাশে ঘটল 'চুনী' পতন! অমৃতলোকের পথে চলে গেলেন ভারতীয় ফুটবলের মহানায়ক। শেষ হল একটা যুগের। ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা ত্রয়ী -র (পি কে, চুনী, বলরাম) প্রথমজন চলে গিয়েছিলেন কিছুদিন আগেই (২০ মার্চ)। প্রিয় বন্ধু প্রদীপ ব্যানার্জির মৃত্যুটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে। বলেছিলেন, "প্রদীপদা তুমি যাচ্ছ যাও। আমিও আসছি"। তাই যেন এবার তিনিও পা বাড়ালেন সেই একই পথে। একরাশ স্মৃতি বুকে নিয়ে পড়ে রইলেন শুধু তুলসীদাস বলরাম। সময়ের কি অদ্ভুত পরিহাস! যে মানুষটার শেষযাত্রায় অগণিত মানুষের ঢল ভেঙে পড়ার কথা, দেশজুড়ে লকডাউন পরিস্থিতিতে সেই মানুষটা চলে গেলেন নীরবে-নিঃশব্দে! সারাজীবন রাজার মতো বাঁচলেও শেষটা হল না রাজার মতো।
জন্ম - ১৯৩৮ সাল
মৃত্যু - ২০২০ সাল
চুনী গোস্বামী — শুধুমাত্র একটি নাম নয়। একটি অধ্যায়। যে অধ্যায়ের শুরু আছে, কিন্তু কোনও শেষ নেই। যে অধ্যায়ের ব্যাপ্তি সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের পথে যাত্রা করেছে। যে অধ্যায় চিরদিনের, চিরকালের —
"ভরা থাক, ভরা থাক
স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি
ভরা থাক, ভরা থাক
মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি
বিষাদের অশ্রুজলে, নীরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী
ভরা থাক, ভরা থাক।"
~ শুভম দে
[তথ্যসূত্র, কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও ছবি সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, এই সময়, আজকাল, দ্য টেলিগ্রাফ, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, নোভি কাপাডিয়া]
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই
আজি তাই শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।"
সালটা ১৯৪৫। তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনের বছর সাতের ছেলেটিকে স্কুলের ক্রিকেট টিমে নিতে চাইতেন না টিমের ক্যাপ্টেন ও তার সহপাঠী, বুদ্ধদেব গুহ (প্রখ্যাত সাহিত্যিক, 'ঋজুদা' -র স্রষ্টা)। কারণ কি? না তার ধারণা ফুটবলের চেয়ে বেশি কঠিন খেলা খেলতে পারবে না ছেলেটি। একদিন দেশপ্রিয় পার্কে একটা ম্যাচে কিছু ছেলে খেলেনি। সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছিল ছেলেটি। কিন্তু যখন পরপর উইকেট পড়তে লাগলো তখন বাধ্য হয়ে সেই ছেলেটিকেই ব্যাট করতে ডাকলেন ক্যাপ্টেন। ব্যাট হাতে অপরাজিত ৪৫ রান এবং বল হাতে ৪ টি উইকেট নিয়ে ছেলেটি বুঝিয়ে দেয় ফুটবলের সাথে ক্রিকেটেও সে সমান পারদর্শী।
কোচবিহার ট্রফির জন্য বাংলা স্কুল টিমের ট্রায়াল চলছে। ট্রায়ালে উপস্থিত বিখ্যাত সাসেক্স অলরাউন্ডার বার্ট ওয়েনসলি এবং ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার পিয়ারসন সুরিতা। ৩০-৪০ জন ছেলের মাঝে ওয়েনসলি বছর চোদ্দোর একটি ছেলেকে লক্ষ্য করলেন এবং ডেকে বললেন "আমি তোমাকে টিচ বলে ডাকব"। কারণ কি? না ছেলেটির বোলিং দেখে কিংবদন্তি ইংলিশ লেগ স্পিনার টিচ ফ্রিম্যানের মতো লেগেছিল সাহেবের। তৃতীয় দিনে তিনি বললেন, "টিচ, তুমি খানিকটা ব্যাট করবে, খানিকটা বল করবে, খানিকটা ফিল্ডিং করবে।" এইভাবেই শুরু হয়েছিল ছেলেটির ক্রিকেট যাত্রা। কে জানত পরে এই ছেলেই বাংলা কে নেতৃত্ব দেবে রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে?
কি মনে হচ্ছে? কোনও ক্রিকেটারের কথা বলছি? তাহলে চলুন ফিরে যাওয়া যাক ১৯৪৬ সালে। ছেলেটির বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। ক্লাস টু -এ পড়ে। দেশপ্রিয় পার্কের মাঠে চুটিয়ে বল পেটায়। কীভাবে যেন কিংবদন্তি ফুটবলার ও কোচ বলাইদাস চ্যাটার্জির (১৯৪৮ অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল টিমের কোচ) চোখে পড়ে যায় ছেলেটি। এরপর ওনার হাত ধরেই মোহনবাগানে আসা। ১৯৪৬ সালে মোহনবাগানের জুনিয়র দলের ট্রায়ালে উত্তীর্ণ হয়ে সেই শুরু। কে জানত ভারতীয় ফুটবলের 'গোল্ডেন বয়' হয়ে উঠবে এই ছেলে?
বল পায়ে তার ম্যাজিক? নাকি বল হাতে চমৎকার রান আপ? শুধুমাত্র কিছু শব্দ দিয়ে কি আর তাকে বর্ণনা করা যায়? শব্দের ভান্ডার যে ফুরিয়ে আসে তার বর্ণময় কেরিয়ারের কথা লিখতে গেলে। তিনি যে মহীরুহ!
ভারতীয় ক্রীড়া জগতের মহাকাশে তাঁর মতো উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়তো আর একটা নেই। ক্রিকেট থেকে ফুটবল, হকি থেকে টেনিস সব খেলাতেই সমান দক্ষ।প্রকৃতপক্ষেই তিনি একজন সত্যিকারের 'অলরাউন্ডার'। অবিশ্বাস্য প্রতিভার অধিকারী সেই মানুষটির নাম সুবিমল গোস্বামী। অবশ্য তাঁর ডাকনামেই (চুনী) সারা বিশ্ব চেনে তাঁকে। জন্ম ১৯৩৮-এর ১৫ জানুয়ারি, অধুনা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। বাবা রেলে চাকরি করতেন। বাবার কর্মসূত্রেই কলকাতায় আসা। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে লেখাপড়া করে নামী কোম্পানিতে চাকরি করুক। খেলায় কখনও উৎসাহ দেননি। কিন্তু মা ছিলেন ঠিক উল্টো। মা ফুটবলের জার্সি, প্যান্ট, জুতো এগিয়ে দিতেন। খেলতে পাঠাতেন ছেলেকে। ফুটবলার হওয়ার পিছনে তাঁর মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। আট বছর বয়সে মোহনবাগান জুনিয়র টিমে ফুটবলে হাতেখড়ি। গুরু বলাইদাস চ্যাটার্জি কি জানতেন আক্ষরিক অর্থে ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যতের 'চুনী' -টিকেই আবিষ্কার করেছেন তিনি?
মোহনবাগান:
১৯৪৬ -এ সেই যে মোহনবাগান জুনিয়র দলে ঢুকলেন সেটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তাঁর ফুটবল জীবনে আর অন্য কোনও ক্লাবে খেলেননি তিনি। তারপর ২৯ মে, ১৯৫৪ তে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিনিয়র দলে অভিষেক। মোহনবাগানের দুই অলিম্পিয়ান রুনু গুহঠাকুরতা এবং আব্দুস সাত্তার চাকরিগত কারণে শেষ মুহূর্তে ম্যাচটা খেলতে পারেননি। অবিশ্বাস্যভাবে ডেবিউ করেছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে থাকা চুনী গোস্বামী। অবশ্য ইস্টার্ন রেলের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে খেলার কথা ছিল রবীন পাত্রের। কিন্তু কোচ বলাইদাস চ্যাটার্জির আশীর্বাদের হাত চুনী গোস্বামীর মাথায় বরাবর ছিল বলেই সেই দিন কোচ জার্সি তুলে দিয়েছিলেন চুনী গোস্বামীর হাতে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। রবিন পাত্র সেই সময় ছিলেন অপরিহার্য রাইট ইন ফরোয়ার্ড। চুনী জুনিয়রে রাইট ইন খেলেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় চুনীকে লেফট ইন ফরোয়ার্ডের জায়গায় খেলানোর। যদিও পরিকল্পনামাফিক নয়, সেই ঘটনার ফলেই চুনী লেফট ইন পজিশনে খেলা শুরু করেন। খেলা ছাড়া অবধি, দেশের সেরা এবং এশিয়ার অন্যতম সেরা লেফট ইন ফরোয়ার্ড ছিলেন চুনী গোস্বামী।টি আও, মহাবীর প্রসাদ, করুণা ভট্টাচার্য, অনিল দে, উমাপতি কুমার, শৈলেন মান্নার মতো ফুটবলারদের মাঝে গুটি সুটি মেরে বসে থাকতেন তিনি। প্রচণ্ড রোগা ছিলেন। অনেকের আশঙ্কা ছিল, রোগা শরীর নিয়ে এই ছেলেটা ফুটবলের মতো বডি কন্ট্যাক্ট গেমে পাল্লা দিতে পারবে কিনা। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। প্রতিভা চাপা থাকেনি। দুরন্ত বল কন্ট্রোল ও ড্রিবলিংয়ে সকলের মন জিতে নিয়েছিলেন।আর এরপরই সবুজ-মেরুনে শুরু হয় চুনী পর্ব। প্রায় ২২ বছর মোহনবাগানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৬০ থেকে অবসর নেওয়া অবধি তিনি ছিলেন ক্লাবের অধিনায়ক। মোহনবাগানের হয়ে গোল করেছেন ২০০ টি (কলকাতা ফুটবল লিগে ১৪৫ টি, আইএফএ শিল্ডে ২৫ টি, ডুরান্ড কাপে ১৮ টি রোভার্সে ১১ টি এবং এইচ কে মুখোপাধ্যায় শিল্ডে ১টি গোল) এবং ২৯ টি ট্রফি (মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৪টি) জিতেছেন (কলকাতা ফুটবল লিগ জিতেছেন ১০ বার, আইএফএ শিল্ড ৫ বার, ডুরান্ড কাপ ৫ বার, রোভার্স ৩ বার, এইচকে মুখোপাধ্যায় শিল্ড ৫ বার এবং বাবু কুয়ের সিং শিল্ড ১ বার ও অমৃতবাজার পত্রিকা শতবার্ষিকী ট্রফি ১ বার)। টানা চারবার কলকাতা লিগ জিতেছেন (১৯৬২- ৬৫), টানা তিনবার আইএফএ শিল্ড জিতেছেন (১৯৬০- ১৯৬২) এবং টানা তিনবার ডুরান্ড কাপ জিতেছেন (১৯৬৩-১৯৬৫)।
ঘরোয়া টুর্নামেন্টে চুনী গোস্বামীর সেরা সাফল্য ছিল ডুরান্ড কাপে। যেখানে মোহনবাগান ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৫ - প্রত্যেক বছর ফাইনাল খেলেছে। ১৯৬৩র ডুরান্ড ফাইনাল রিপ্লে হয়েছিল। অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে চুনী দুই হাফেই গোল করে দলকে ২-০ জেতায়। সেই প্রথমবার তাঁর হায়দরাবাদের পুলিশ টিমকে হারায়। তার আগে দু’বার ১৯৫০ এবং ১৯৬১-তে মোহনবাগান অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের কাছে ফাইনালে হেরেছিল। ১৯৬৪-তে টাটা স্পোর্টস ক্লাব এবং ১৯৬৫-তে অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে চুনী গোস্বামীর করা গোলেই মোহনবাগান ফাইনালে উঠেছিল।
ডুরান্ড কাপ ভারতের প্রাচীনতম এবং ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট। ডুরান্ড ফাইনালে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকতেন এবং দুই দলের অধিনায়কের সঙ্গে চা পান ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। তখন ১৯৬৫ তে, রাষ্ট্রপতি ডা. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন দিল্লি গেট স্টেডিয়ামে (বর্তমানে, আম্বেদকর স্টেডিয়াম) গিয়েছিলেন মোহনবাগান আর পঞ্জাব পুলিশের মধ্যে ডুরান্ড কাপ ফাইনাল দেখতে। মোহনবাগান বেঞ্চের সামনে চুনীকে ওয়ার্ম আপ করতে দেখে, রাষ্ট্রপতি চুনীকে গিয়ে বলেন - "ওহ্ আবার চুনী! তুমি তো ফাইনাল খেলাটা একেবারে পাকা করে ফেলেছ দেখছি।" এমনই ছিল চুনী গোস্বামীর খ্যাতি এবং মর্যাদা।
মোহনবাগান শুধুমাত্র একটি ক্লাব ছিল না তাঁর কাছে। মোহনবাগান ছিল তাঁর কাছে মাতৃসম। শোনা যায় একবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লাল-হলুদের জেনারেল সেক্রেটারি জে সি গুহ (জ্যোতিষ চন্দ্র গুহ) তাঁকে ইস্টবেঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ষাটের দশকে বাজারে নতুন আসা জনপ্রিয় ফিয়াট গাড়ি উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও ‘সবুজ-মেরুন' -এর তাঁবু থেকে ভাঙানো যায়নি তাঁকে। অত্যন্ত নম্রতার সাথে উনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রিয় মোহনবাগানেই থেকে যান। এমনই ছিল তাঁর মোহনবাগান প্রেম যে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইউরোপের বিখ্যাত ক্লাবে ট্রায়ালের প্রস্তাবও! তখন দেশের হয়ে ও ক্লাবের হয়ে চুটিয়ে খেলছেন চুনী গোস্বামী। সেই সময় সুদূর সাগরপাড় থেকে প্রস্তাব আসে তাদের ক্লাবের ট্রায়ালে যোগ দেওয়ার জন্য। তাদের ম্যানেজার ছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার বিল নিকোলসন। কিন্তু তিনি যাননি। মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন ছিলেন তখন। মোহনবাগানের বিখ্যাত কর্তা ধীরেন দে তাঁকে বলেছিলেন, "ওখানে একা একা থেকে কী করবে?" তাই আর ইংল্যান্ডে গিয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। ক্লাবটির নাম ছিল টটেনহাম হটস্পার! ক্লাবের প্রতি ভালবাসা এতটাই গভীর ছিল যে আলাদা করে কখনও বেতন নেননি। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "মোহনবাগানে প্র্যাকটিসের পর কলা আর পাউরুটি দেয়। ওটাই যথেষ্ট।" এখানেই চুনী গোস্বামী ছিলেন শ্রেষ্ঠ। বাকি সবার থেকে আলাদা। মোহনবাগান ক্লাবের প্রতি তাঁর আনুগত্য, দায়বদ্ধতা তাঁর নাম মোহনবাগান ক্লাবের সাথে সমার্থক করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন মোহনবাগানের ঘরের ছেলে।
সন্তোষ ট্রফি:
বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেছেন ১৯৫৬-১৯৬০। গোল করেছেন ২৫ টি। চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনবার। ১৯৫৬ তে প্রথম সন্তোষ খেলেন চুনী গোস্বামী। এরনাকুলামে মহীশূরের বিরুদ্ধে বাংলার হয়ে জয়সূচক গোল করেন পি কে। সেই গোলটি এসেছিল চুনী গোস্বামীর থ্রু পাস থেকেই।
ভারতীয় ফুটবল দল:
১৯৫১ থেকে ১৯৬২ - এই সময়টাকে ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। আর এই স্বর্ণযুগের দ্যুতি আরও উজ্জ্বলতর করে তুলেছিলেন চুনী গোস্বামী নিজ মহিমায়। পি কে, চুনী, বলরাম (তুলসীদাস বলরাম) - এই ত্রয়ী কে তখন ভারতীয় ফুটবলের 'ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর' বলা হত। আন্তর্জাতিক ১৯৫৬ সালে এক স্মরণীয় ম্যাচে ভারতীয় ফুটবল পেয়েছিল তার 'চুনী' কে। সেই ম্যাচে ভারতীয় দল ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল অলিম্পিকে খেলা চিনা দলকে। আর এই ম্যাচেই ভারতীয় জার্সি গায়ে আবির্ভাব ঘটে বছর উনিশের এক যুবকের - যার নাম সুবিমল 'চুনী' গোস্বামী। ১৯৫৬ -র মেলবোর্ন অলিম্পিকে উপেক্ষিত হলেও ১৯৫৮ -র টোকিও এশিয়ান গেমসে ধুরন্ধর কোচ বাঘা সোম ২০ বছরের যুবকটিকে দলে নেন। এরপর আর কেউ তাঁর দক্ষতা অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস দেখায়নি। ২৬ শে মে ১৯৫৮, টোকিও এশিয়ান গেমসে বার্মার বিরুদ্ধে প্রথম গোল করেছিলেন। ভারত জিতেছিলেন ৩-২ গোলে। ভারতের হয়ে ৩৬ টি ম্যাচ খেলেছিলেন। ক্যাপ্টেন ছিলেন ১৬ টি ম্যাচে। গোল করেছেন ১৩টি। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে চুনী গোস্বামীর সেরা সাফল্য জাকার্তায় চতুর্থ এশিয়ান গেমসের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ হারিয়ে স্বর্ণপদক জয়। সেমিফাইনালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে ৩-২ জয়ের কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। দক্ষিণ ভিয়েতনাম দলের ৮ জন খেলোয়াড় সেই সময় ফ্রেঞ্চ লিগে খেলত। সেই ম্যাচে চুনী গোস্বামী জোড়া গোল করেন। তাঁর নেতৃত্বেই ভারত ১৯৬৪-তে ইসরাইলের তেল আভিভ এশিয়া কাপে রানার্স হয়। ১৯৬৪-র মারডেকা কাপেও চুনী অধিনায়কত্ব করেন।
একনজরে ভারতীয় দলে চুনী গোস্বামী:
প্রীতি ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট:
এশিয়ান গেমস - ১৯৫৮ ও ১৯৬২ জাকার্তা (ক্যাপ্টেন)
এশিয়া কাপ যোগ্যতা অর্জন ম্যাচ - ১৯৫৯ (এর্নাকুলাম)।
এশিয়া কাপ - ১৯৬৪ (তেল আভিভ)
প্রাক অলিম্পিক পর্ব - ১৯৫৯ (কাবুল), ১৯৬০ (কলকাতা), ১৯৬৩ (কলম্বো), ১৯৬৪ (তেহরান/ কলকাতা)
প্রীতি ম্যাচ - ফার্মোসার বিরুদ্ধে ১৯৬৪।
অলিম্পিক - ১৯৬০, মারডেকা কাপ ১৯৬১ ও ১৯৬৪ (ক্যাপ্টেন), প্রীতি ম্যাচ-১৯৬৪।
শচীন টেন্ডুলকার কে যদি ভারতীয় ক্রিকেটর ঈশ্বর বলা হয়, তাহলে চুনী গোস্বামী ছিলেন 'গড্ অফ ইন্ডিয়ান ফুটবল'। ড্রিবলিং -এ উনি ছিলেন ভারতের রোনাল্ডিনহো-রবিনহো। ভারতীয় ফুটবলের জাদুকর, যিনি ফুটবলে পা দিলেই ঘটত ম্যাজিক। উজ্জ্বলতা এবং লাবণ্যের বিচ্ছুরণ ফুটে উঠত মাঠজুড়ে। এহেন খেলোয়াড় যে যেকোনো টিমের কাছে সম্পদ যা ভালো করে জানতেন তদানীন্তন ভারতীয় ফুটবল টিমের বিখ্যাত কোচ সৈয়দ আবদুল রহিম। এমনকী দেরিতে জাতীয় দলে যোগ দিলেও কেউ অভিযোগ করত না তাঁর বিরুদ্ধে। ১৯৬০ -এ রোম অলিম্পিকের আগে প্রায় ১৫ দিন দেরিতে গোশামহল স্টেডিয়ামে জাতীয় শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিছু খেলোয়াড় এই নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন কোচের কাছে । কিংবদন্তি রহিম তাঁদের বলেছিলেন, "উসকে মাফিক বল কন্ট্রোল কর লো, তুম ভি ফির লেট আনা।" হ্যাঁ এই হচ্ছে চুনী গোস্বামী। ভারতীয় ফুটবলের 'গ্ল্যামার বয়'!
রাজার মতো থাকতে পছন্দ করতেন সব সময়। নিজেকে সুসজ্জিত রাখতে পছন্দ করতেন। মাঠ হোক বা মাঠের বাইরে তাঁর সবটাই ছিল রাজকীয়। আন্তর্জাতিক ফুটবল কে থেকে বিদায়ও জানিয়েছিলেন রাজার মতোই। ১৯৬৪ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে নিজের সেরা ফর্মে থাকাকালীন। সদ্য এশিয়ান কাপে রানার্স আপ হয়েছেন। আর সৈই সময়েই অবসর ঘোষণা। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কারণটা, যে এখনকার অনেকের মতো এটা শুনতে চাননি কেন চুনী খেলা ছাড়ছে না? বরং উল্টোটাই শুনতে চেয়েছেন, কেন ছাড়ল? যখন তিনি অবসর ঘোষণা করলেন, মুম্বাইয়ে তাঁর খেলার দুই বিশেষ ভক্ত তাঁর সাথে দেখা করে তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এই দুজন ভদ্রলোক হলেন দিলীপ কুমার এবং প্রাণ - বলিউডের এই দুই আইকন! আর এখানেই চুনী গোস্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিলেও ১৯৬৮ অবধি মোহনবাগানের হয়ে খেলা চালিয়ে যান তিনি।
ক্রিকেটের ২২ গজে চুনী গোস্বামী:
আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ঘোষণার পর সকলেই ভেবেছিলেন এবার হয়তো কোচিংয়ে দেখা যাবে তাঁকে বা স্টেট ব্যাঙ্কের মোটা মাইনের চাকরিতে মনোনিবেশ করবেন তিনি। কিন্তু তিনি চুনী গোস্বামী। থেমে থাকার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। খেলার মাঠই তাঁর জীবন। সব গুঞ্জন থামিয়ে ফিরে গেলেন ফুটবলের সাথে সমানতালে যে খেলাটা খেলে এসেছেন এতদিন সেই - ক্রিকেটের বাইশ গজে। আর তারপরেই ঘটল এমনকিছু ঘটনা যা যেকোনো মহাকাব্যকেও হার মানায়। ক্রিকেটের বাইশ গজে ঘটল 'চুণী' গজে ঘটল 'চুণী' গজে ঘটল 'চুণী' নামক রত্নের বিচ্ছুরণ! ! ! ক্রিকেটের মাঠে নিজের সীমিত ক্ষমতার যে বহিঃপ্রকাশ তিনি ঘটিয়েছিলেন তাতে আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা একটা 'ডেনিস কম্পটন' পায়নি আমাদের দেশে! ডানহাতি ব্যাটসম্যান তথা ডানহাতি ফাস্ট মিডিয়াম বোলার হিসাবে প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে ৪৬ টি ম্যাচ খেলেছিলেন চুনী গোস্বামী এবং একটি সেঞ্চুরি ও সাতটি হাফ-সেঞ্চুরি সহ ১৫৯২ রান করেছিলেন। সর্বোচ্চ রান ছিল ১০৩।বল হাতে একবার এক ইনিংসে ৫ উইকেট-সহ ৪৭ টি উইকেট নিয়েছিলেন, সেরা বোলিং ছিল ৫/৪৭। ১৯৬২-৬৩ মরশুমে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক ঘটেছিল তাঁর এবং ১৯৭২-১৯৭৩ অবধি বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলেছেন।
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩।
বাংলার হয়ে রঞ্জি অভিষেক আর প্রথম ম্যাচেই হেলমেটহীন অবস্থায় সামলাতে হয়েছিল হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের রক্তঝরানো ফাস্ট বোলার রয় গিলক্রিস্ট কে। গিলক্রিস্টের খুনে মেজাজ এবং যথেচ্ছ বাউন্সার-বিমার ব্যবহারের জন্য যে ম্যাচ কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। বাংলা অধিনায়ক পঙ্কজ রায়কে বিমার ছুড়ে মারতে গিয়েছিলেন গিলক্রিস্ট। ছয় নম্বরে নেমে গিলক্রিস্টকে সামলে চুনী গোস্বামীর ৪১ রান বাংলাকে প্রথম ইনিংসের লিড নিতে সাহায্য করেছিল। ইডেন দেখেছিল এক দুঃসাহসী চুনী কে।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।
বোম্বের বিপক্ষে ১৯৬৮-৬৯ -এর ড্র হওয়া রঞ্জি ফাইনালেও চুনী গোস্বামী বাংলা দলের অংশ ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ৯৬ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৪ রান করেছিলেন। তবে প্রথম ইনিংসের ঘাটতির কারণে বাংলা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
১৯৭১-৭২ রঞ্জি ট্রফি
তাঁর নেতৃত্বে বাংলা রঞ্জি রানার্স হয়েছিল ১৯৭১-৭২ সালে, ফাইনালে গাভাসকার-অশোক মানকড়-ওয়াদেকার-সোলকার-রমাকান্ত দেশাই-শিভালকার সমৃদ্ধ বম্বের কাছে ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে হেরে গিয়েছিল বাংলা। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে মহারাষ্ট্র আর সেমিফাইনালে পাতৌদি-জয়সীমা-আবিদ আলি সমৃদ্ধ হায়দরাবাদকে হারিয়ে দেওয়ার পিছনে অনেকাংশেই সক্রিয় ছিল বাংলা অধিনায়কের প্রখর মস্তিষ্ক।
তবে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে সেরা মুহূর্তটা ছিল ১৯৬৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, যা প্রায় লোকগাথায় পরিণত হয়।
আগে যখন বিদেশি দল ভারতে আসত, ওরা প্রস্তুতি ম্যাচ খেলত রঞ্জি ট্রফি জয়ী দলের সঙ্গে বা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে। ১৯৬৬ -তে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এল ভারত সফরে, ওরা তখন বিশ্বের এক নম্বর দল। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সিদ্ধান্ত নিল মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল - দু’টো আঞ্চলিক টিমকে এক করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলার জন্য যৌথ একাদশ গড়া হবে। হনুমন্ত সিংহ ছিল ছিল ক্যাপ্টেন। সব মিলিয়ে ছ’জন ছিল পূর্বাঞ্চল থেকে। দলজিৎ সিং, রমেশ সাক্সেনা, অম্বর রায়, সুব্রত গুহ,দেবু মুখোপাধ্যায় ও চুনী গোস্বামী। আর গ্যারি সোবার্স, রোহন কানহাই, ক্লাইভ লয়েড, ডেরেক মারে, ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ -এর মতো ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা সব নাম ছিল সেই ক্যারিবিয়ান দলে। যদিও সোবার্স আর কনরাড হান্ট প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলেননি। ইংরেজি সংবাদপত্রে শিরোনাম বেরিয়েছিল 'উইকেস্ট অপোজিশন টু ফেস মাইটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ'! স্টেট ব্যাঙ্কে খেলার সুবাদে অধিনায়ক হনুমন্ত সিংহ চুনী গোস্বামীকে চিনতেন। ওনার হাতে যে ভাল ইনসুইং আছে, সেটা জানত হনুমন্ত। টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমে ব্যাট করেছিল। কিন্তু চুনীর মিডিয়াম পেস সুইং ও সিম বোলিংয়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বিশ্বসেরা ক্যারিবিয়ান মহারথীরা! চুনী গোস্বামীর প্রথম কয়েকটা বল খেলার পর রোহন কানহাইয়ের মতো ব্যাটসম্যান এগিয়ে এসে চুনীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিলেন, "ইউ হ্যাভ গট অ্যা ফাকিং সুইং ম্যান"। আম্পায়ারের কাছে নতুন করে গার্ড চেয়েছিলেন কানহাই। কানহাই মাত্র ৪ রান করে চুনীর বলে গালিতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যায়। ১৩৬ রানে শেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ! চুনী গোস্বামী ৪৭ রান দিয়ে ৫ উইকেট। অবাক লাগছে? তাহলে অবাক হওয়া আরও বাকি।
২৮৩-৯ স্কোরে ডিক্লেয়ার করছিলেন ক্যাপ্টেন হনুমন্ত। ১৪৭ রানে এগিয়ে গেল মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মিলিত দল। বল হাতে চুনী-ম্যাজিকের পর ব্যাট হাতে ২৫ রান করেছিলেন চুনী গোস্বামী। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে এসে ফের চুনীর সুইংয়ের সামনে ধরাশায়ী। এবার ৩ উইকেট ঝুলিতে। শেষের দিকে ওয়েস হল আর লেস্টার কিং মিলে চালিয়ে খেলে রান তুলতে থাকে। আর এবার দেখা গেল ফিল্ডার চুনী গোস্বামীর এক ঝলক। হল, সুব্রত গুহর বল স্ক্যোয়ার লেগের দিকে তুলে মারলে, মিড-অন থেকে দৌড় শুরু করেন চুনী গোস্বামী। খুব উঁচুতে উঠেছিল বলটা। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছে এক হাত বাড়িয়ে অবিশ্বাস্য ক্যাচটি নিয়েছিলেন চুনী। বিস্ময়!
১০৩ রানে প্রতিপক্ষ কে শেষ করে দিয়ে মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মিলিত দল ম্যাচ জিতেছিল এক ইনিংস ও ৪৪ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারের অপমানের বদলা নিতে পরের টেস্টে ইনিংসে হারায় ভারতকে। কিন্তু সে যাইহোক সারা জীবনের মতো ভারতীয় ক্রিকেটের লোকগাথায় ঢুকে গিয়েছিল চুনী গোস্বামীর এই অসাধারণ পারফরম্যান্স। মাঠের মধ্যে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি, বিড়বিড় করে বলতেন, "চুনী, তুমি বাঘের বাচ্চা, লড়ে যাও শালা, ছাড়বে না"।
এই ছিল চুনী গোস্বামী। একইসাথে দুটো খেলায় (ফুটবল ও ক্রিকেট) রাজ্যদলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমন খেলোয়াড় আসমুদ্র-হিমাচলে আর একটাও নেই। ঈশ্বরপ্রদত্ত না হলে কি এমন প্রতিভাধর কোনো মানুষ হতে পারে? তবে ক্রিকেট খেলতে ভালবাসলেও নিজেকে একজন ফুটবলার বলতেই গর্ববোধ করতেন তিনি।
টেনিসের কোর্টে চুনী:
ফুটবল-ক্রিকেট কে বিদায় জানানোর পর এবার টেনিস। খেলাধুলাই ছিল তাঁর জীবন। টেনিস ভালোবাসতেন তিনি। ফুটবল-ক্রিকেট থেকে অবসরের পর তাঁকে প্রায়শই দেখা যেত ক্যালকাটা সাউথ ক্লাবের টেনিস কোর্টে।
স্টেট ব্যাঙ্কের চৌরঙ্গী শাখায় ম্যানেজার ছিলেন তিনি। যেখানে ইস্টবেঙ্গলের সুকুমার সমাজপতি অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে কাজ করতেন। ১৯৭০ -এর শেষের দিকে গ্রীষ্মকালে যখন লোডশেডিং হয়ে যেত, ব্যাঙ্কে হাজার গ্রাহকের চাপ থাকুক, চুনী গোস্বামি চুপচাপ মধ্যাহ্নভোজনের পর চলে যেতেন সাউথ ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবে। মোমবাতির আলোয় গ্রাহকদের ভীড়ে কাজে ভীষন অসুবিধা হত সুকুমার সমাজপতির। কিন্তু চুনী গোস্বামী কখনও টেনিস মিস্ করতেন না। মোহনবাগানের হয়ে একটি ক্লাব টুর্নামেন্টও জিতেছিলেন জয়দীপ মূখার্জীর ও তিনি একসাথে খেলে।
লম্বা সুঠাম শরীরখানি আশি বছর বয়সেও সেই একইরকম ফিট ছিল। আগেই বলেছি বরাবর রাজার মতো থাকতে ভালোবাসতেন। নিজেকে নাম্বার ওয়ান মনে করতেন। মেজাজটাই ছিল আসল রাজা। ড্রেস সেন্স ও স্টাইল-স্টেটমেন্টে টেক্কা দিতে পারতেন এখনকার যেকোনো খেলোয়াড় কে। বর্তমান সময়ের স্টার হলে হাজারো বাণিজ্যিক সংস্থা তাঁকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করার জন্য উঠে পড়ে লাগত। অবশ্য চুনী গোস্বামী নিজেই একটা ব্র্যান্ড।
বর্তমান সময় যেভাবে মেসি-রোনাল্ডো কে পুজো করে, ওনার প্রজন্ম ওনাকে ঠিক সেইভাবেই পুজো করত এবং ভবিষ্যতেও করবে। ফুটবল পায়ে স্কিল, উজ্জ্বলতা এবং লাবণ্যে ভরা এক কিংবদন্তি। ওনার বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং, স্কিল, এবং বুদ্ধিদীপ্ত পাসিং ওনাকে সর্বভারতীয় স্তরে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিল। ফুটবল দক্ষতায় উনি ছিলেন রোনাল্ডিনহো বা রবিনহোর সমকক্ষ এবং সেই সময়ের যেকোনও ব্রাজিলীয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম ছিলেন। বর্তমান ভারতে মেসি বা রোনাল্ডোর ভক্ত সংখ্যার থেকেও বেশি ছিল তাঁর ভক্তের সংখ্যা। মোহনবাগানের হয়ে গোল করার পর কোমড়ে হাত দিয়ে মুচকি হেসে গ্যালারির দিকে তাঁর সেই তাকানো, খেলার পর যথারীতি 'গুরু, গুরু' বলে ভক্তদের চুনী গোস্বামীর পায়ে ডাইভ দেওয়ার দৃশ্য যারা তার খেলা দেখেছেন তাদের স্মৃতিতে আজও অমলিন। গগনচুম্বী ছিল তাঁর গ্ল্যামার। 'ময়দানের উত্তমকুমার' বলা হত ভারতীয় ফুটবলের 'গ্ল্যামার বয়' কে। এমনই জনপ্রিয়তা ছিল যে, দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তদের পাঠানো ঠিকানাবিহীন চিঠি তাঁর যোধপুর পার্কের বাড়ির লেটার বক্সে পৌঁছে যেত। খামের উপর শুধু লেখা থাকত - চুনী গোস্বামী, ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম, কলকাতা। সেইসময় নায়ক তো ছিলেন একজনই। আর তিনি চুনী গোস্বামী।
শোনা যায়, ১৯৬০ -এর দিকে একজন বৃদ্ধা রোজ ভোরবেলায় কালীঘাটে যেতেন। কিন্তু ফেরার সময় ভীড় বাড়লে তার অসুবিধা হত ট্রাম ধরতে। পাশের কাউকে তখন তিনি বলতেন, "আমি চুনী গোস্বামীর ঠাকুমা"। ব্যাস, শুধু বলার অপেক্ষা উপস্থিত সকল জনতা শুধু ট্রাম ধরিয়ে দেওয়ায় নয় পারলে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত একেবারে! এমনই ছিল চুনী গোস্বামীর জনপ্রিয়তা। ভক্তরা তাঁর জন্য সবকিছু করতে পারত। একবার ১৯৬৫ সালে কেরলের কুইলনে সন্তোষ ট্রফি খেলতে গিয়েছিল বাংলা দল। কিন্তু সেই দলে চুনী গোস্বামী ছিলেন না। স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীদের ক্ষোভ সামাল দিতে স্টেডিয়ামের বাইরে সংগঠকদের ওঁর মোমের মূর্তি বসাতে হয়েছিল। এই হচ্ছে চুনী গোস্বামী। ভারতীয় ফুটবলের মেগাস্টার।
চুনী গোস্বামী ছিলেন সেই নতুন ভোর যার হাত ধরে বিশ্বায়ন ঘটেছিল ভারতীয় ফুটবলের ভাগ্যাকাশে। স্টেডিয়াম ভর্তি জাকার্তায় যেদিন হাজার হাজার জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল সেদিন কি অনুভূত হয়নি সেই বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত?
"মহারাজ একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে
চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে
মহারাজ একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে
চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে
মহারাজ একি সাজে..."
এ কি বিশ্বকাপের থেকে কম কিছু? তবু বিশ্বকাপ না খেলতে পারার আক্ষেপ ছিল তাঁর। এই পোড়া দেশে না জন্মালে হয়তো বিশ্বকাপ খেলার তকমাটাও জুড়ে যেত তাঁর সাথে।
এতসব রেকর্ড, এত জনপ্রিয়তা, এত খ্যাতি - সবকিছুর মায়া যেন ছিন্ন হল গত ৩০ শে এপ্রিল। নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাসে ভারতীয় ক্রীড়া জগতের মহাকাশে ঘটল 'চুনী' পতন! অমৃতলোকের পথে চলে গেলেন ভারতীয় ফুটবলের মহানায়ক। শেষ হল একটা যুগের। ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা ত্রয়ী -র (পি কে, চুনী, বলরাম) প্রথমজন চলে গিয়েছিলেন কিছুদিন আগেই (২০ মার্চ)। প্রিয় বন্ধু প্রদীপ ব্যানার্জির মৃত্যুটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে। বলেছিলেন, "প্রদীপদা তুমি যাচ্ছ যাও। আমিও আসছি"। তাই যেন এবার তিনিও পা বাড়ালেন সেই একই পথে। একরাশ স্মৃতি বুকে নিয়ে পড়ে রইলেন শুধু তুলসীদাস বলরাম। সময়ের কি অদ্ভুত পরিহাস! যে মানুষটার শেষযাত্রায় অগণিত মানুষের ঢল ভেঙে পড়ার কথা, দেশজুড়ে লকডাউন পরিস্থিতিতে সেই মানুষটা চলে গেলেন নীরবে-নিঃশব্দে! সারাজীবন রাজার মতো বাঁচলেও শেষটা হল না রাজার মতো।
জন্ম - ১৯৩৮ সাল
মৃত্যু - ২০২০ সাল
চুনী গোস্বামী — শুধুমাত্র একটি নাম নয়। একটি অধ্যায়। যে অধ্যায়ের শুরু আছে, কিন্তু কোনও শেষ নেই। যে অধ্যায়ের ব্যাপ্তি সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের পথে যাত্রা করেছে। যে অধ্যায় চিরদিনের, চিরকালের —
"ভরা থাক, ভরা থাক
স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি
ভরা থাক, ভরা থাক
মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি
বিষাদের অশ্রুজলে, নীরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী
ভরা থাক, ভরা থাক।"
~ শুভম দে
[তথ্যসূত্র, কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও ছবি সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, এই সময়, আজকাল, দ্য টেলিগ্রাফ, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, নোভি কাপাডিয়া]
খুব সুন্দর লেখা। অনেক অজানা তথ্য এক জায়গায় পেয়ে গেলাম।
ReplyDeleteThank you dada. Pase thakben. 😊
Deleteখুব অসম্ভব সুন্দর লেখা
ReplyDeleteThank you.
Delete